ইলমে মারেফত
ভক্ত বা মুরিদের প্রতি গুরুর কাজ কি?

ভক্ত বা মুরিদের প্রতি গুরুর কাজ কি?
সদ্ গুরু বা মূর্শিদের কাজ ভক্তের বা মুরিদের অনন্ত মুক্তির দিকে প্রেরনা দেওয়া। চাল, কলা, আলু, পটল জোগাড়ে তার মন নেই, মুরিদের দেওয়া ছাগল, গরু, হাস, মুরগি, ডিম, দুধ কলা বা হাজার হাজার টাকা লাখ টাকা নজরানা, দক্ষিনায় ও তার মন নেই। ধর্মিও বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানে তার পুজাপ্রাপ্তিতেও মন নেই। ভক্ত বা মুরিদের আত্ম উন্নতিতেই তার আনন্দ, ভক্তের কল্যানেই তিনি খুশী।
সুতরাং গুরুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে, প্রানপনে আত্মগঠন আর প্রানপনে অগ্রগমন। ভক্ত যদি পথ এগিয়ে না যায়, তবে গুরুর মহত প্রানের মহত উদ্দেশ্যটি সফল হয় না, বা তিনি ব্যার্থকাম হন আর এতে ভক্তের অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ হয়। টাকা অর্থ কড়ি ছাগল,গরু ফুল ফল নানান জিনিস দিয়ে গুরুর পায়ে ভক্তি সেজদা, পাদপদ্ম পুজা করলেই গুরুকে খুশি করা বা কৃতজ্ঞতা করা হলো না, গুরুকে অবতার বলে প্রচার করলেও না, বা তার নামে গান বেধে ঢাক,ঢোল বা নানা ভাবে তার প্রচার করলেও সদ্ গুরু খুশি হন না। তার খুশি ভক্তের আত্মিক উন্নয়নে।
“এই সবে খুশি হন অসৎ গুরুরা যারা লেবাজ বা বেশ নিয় বসে আছেন, তারা ভক্তের অর্থ ও বিষয় বস্তুর আশায় বসে থাকেন। তাদের কাছে নিয়ে আসা গরু,ছাগল,হাঁস,মুরগি তারা আরামছে কেটে কুটে তমসাছন্ন হয়ে তমসিক খাদ্য মনের সুখে দরবারের সবাই মিলে খেয়ে যাচ্ছেন প্রতি নিয়ত।”
অসৎ গুরুরা ভক্তের স্বাধীনতা দেই না বরং অন্ধ মুক করে রাখে। এদের পায়ে মাথা লুটান বিড়ম্বনা, তাদেরকে মুক্তিদাতা ভাবে গ্রহন করাও এক অশান্তি। ভক্তের স্বধীন চেতনার সন্মান রেখে যিনি পরমআত্মা বা পরমার্থের পথ দেখাতে পারবেন না, তাকে দুর থেকে সালাম দিয়ে বিদায় হওয়া ভাল,তার শাসনকে জিবনের উপর চাপতে না দেওয়ায় ভাল।
এখন যা গুরুবাদ চলছে,তা পুরাই জচ্চুরির দুর্গ। ধর্ম প্রচারকেরা উপদেষ্টারা চাচ্ছে,দুনিয়ার সব লোককে অন্ধ করে রেখে নিজেদের খেয়ালমত চালিয়ে নিতে।কেউ তার শিষ্যকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নয়। আনুগত্যের নাম করে গুরুরা ভক্তের চখে ঠুসি বেধে দিচ্ছে। কোনো গুরু ভক্তেদের নিজ নিজ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর দাড়াতে দিচ্ছে না, সবাই বলছে এটা কর,এটা মানো,ওটা মানো, যেহেতু আমি গুরু বলছি! ভক্তের নিজের বিচার বুদ্ধিকে, স্বাধীন অনুধাবনার ক্ষমতাকে কেউ জাগ্রত করছে না, সবাই বলছেন আমাকে মানো আমার ধ্যান কর,পুজা কর,স্মরণ,মনন কর। কারো কারো গুরু গৌরব এতো বেশী অতিক্রম করে যাচ্ছে,যা বক্তব্য নয়, তাই তারা বলছে, যা কর্ত্তব্য নয়, তাই তারা করছে, যা ভাবা উচিত নয়, তাই তারা ভাবছে,যা ভাবানো উচিত নয় তাই তারা ভাবাচ্ছে।এই শ্রেনীর গুরুরা মানুষ্যত্বের কলঙ্ক বা অপচায়ক।
আমার মতে তিনিই সদ্ বা প্রকৃত গুরু,যিনি সৎ সাহসে বুক ঠুকে বলতে পারবে, আমার মধ্যে যদি অসৎ কিছু দেখো তবে সত্যের জন্য আমাকে অগ্রাহ্য কর বা পরিত্যাগ কর,এমন কি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রহ কর কেনো না এ জগতে সত্যই সর্বাপেক্ষা গুরু তার তুলনায় জগতে আর সব কিছুই লঘু। সদ্ গুরু বলবে যদি প্রত্যক্ষ সত্য আমার কাছে কিছু পাও তবেই আমাকে মেন, নইলে ছেড়া কাঁথার মত আমাকে বর্জ্জন করো, উচ্ছিষ্ট খাদ্যের মত আমাকে বর্জ্জন করো। অনুমানে আমাকে মানতে যেও না,মানতে হয় তো প্রত্যক্ষ নির্ভর করে মানো। আমার কথায়,চিন্তায়,কার্য্যে যদি অসত্য দেখতে পাও তবে ওটা আমার একটা লীলা ভেবে মনকে ফাকি দিও না, অসত্যের প্রতিবাদ করতে নির্ভীক চিত্তে দণ্ডায়মান হও, মিথ্যা অমান্য করো।
কানে একটা মন্ত্র বা কলেমা দিলেই মূর্শিদ বা গুরু হওয়া যায় না,গুরু হওয়া বড় শক্ত কথা। আজকাল এই যে কত সহজে একজন আর একজনের গুরু হচ্ছে,তার ফল কি হচ্ছে? যত্ন করে কষ্ট করে গুরু পদবি লাভ করতে হলো না বলে গুরু তার মনুষ্যত্বে খাটো হয়ে যায়। আর মনুষ্যত্বে খাটো হন বলেই বিদ্রোহী ভক্তকে ক্ষমা করতে পারে না, আর্শীরবাদ করে বলতে পারে না – সত্যের জন্য আমাকে বর্জ্জন কর, আমার প্রতি মোহকৃষ্ট হয়ে সত্যকে অবমাননা করো না। গুরুর নিজের জীবনের জ্বলন্ত মনুষ্যত্ব দেখিয়েই বর্তমানের ভক্তের মনুষ্যত্ব প্রয়াসী চিত্তকে আকৃষ্ট করতে হবে। তাতে গুরুরও লাভ ভক্তেরও লাভ। সদ্ গুরুর কথা-যেদিন দেখবা আমি তোমাদের কল্যানে বিঘ্ন হচ্ছি, ধর্মলাভের অন্তরায় বা বাধা হচ্ছি, স্রষ্ঠাকে পাবার বাধা হচ্ছি,সেদিন আমাকে ত্যাগ করবা। আর একটা কথা তিনি বলবেন- সত্যই গুরু, সত্যকে যে ত্যাগ করে, সে-ই গুরু ত্যাগী।
বর্তমানে অসৎ গুরুরা ভক্তকে বললো- কৈ আমার সালামি, দক্ষিনা,নাজরানা উপঢৌকন কৈ? ভক্ত অমনি কাড়ি কাড়ি ব্যাগ ভর্তি টাকা গরু,ছাগল ও অনান্য বস্তু যার যেমন সামর্থ হলো সে তেমন দিলো। যে ভক্ত অধিক কিছু দেই সেই গুরুর অতি প্রিয় পাত্র হয় বা বড় ভক্ত হয়ে যায়, আর অসহায় গরিব ভক্তগুলো অধিক কিছু দিতে না পরাতে পীর সাহেব বা গুরুর প্রিয় পাত্র হতে পারে না এমন কি ঐ গুরু গরিব ভক্তের সাথে হাসি মুখে কথাও বলে না। তখন গরিব ভক্তদের হৃদয়ে কষ্ট হয়,যা ঐ অসৎ গুরু অনুভব করতে পারে না। এই শ্রেনীর গুরুরা পরমআত্মার সাক্ষাত পাইনি বা ব্রক্ষের উপলব্ধি করে নি, কিন্তু অজ্ঞ মূর্খ অশিক্ষিত সহজ সরল ভক্তদের কাছে বারবার শুধু একই কথা বলে আমি ব্রক্ষ,আমি পরাতপর পরমআত্মা,আমি উপাস্যের উপাস্য,আমি মুর্শিদ আমি রাসুল আমিই সব তোমাদের। তোমরা কখনো গুরুকে মানুষ জ্ঞান করবা না।
এই সব হলো অসৎ গুরুদের কথা।
আর সদ্ প্রকৃত গুরুর কথা- গুরুদক্ষিনা প্রকৃতই অদেয়। অর্থাত সর্ব্বস্ব দিলেও যোগ্যভাবে দেওয়া হয় না বা হয়ে উঠে না, এইজন্য গুরুকে না দিতে পারলেও দিতে হয় জগতকে।জগত সেবাই গুরু সেবা। গুরুর কাছ হইতে যে উৎসাহ,যে উদ্দীপনা ও যে প্ররনা ভক্ত পায় তাহা বিশ্বজগতে ছড়াইয়া দেওয়ার নামই গুরু দক্ষিনা। গুরু যত স্বর্থত্যাগ করে ভক্তের জন্য,জগতের জন্য ভক্তকে ততখানি স্বার্থত্যাগ করতে হয়। গুরু ভক্তকে যতখানি ভালবাসে,ভক্তকে ততখানি জগতকে ভালবাসতে হয়। যতখানি তিনি ভক্তের জন্য কেঁদে আকুল হয়,ততখানি জগতের জন্য ভক্তকে কাঁদতে হয়। তবেই গুরু দক্ষিনা দেওয়া হবে। গুরু দক্ষিনা দেওয়া সহজ কথা নয়, গুরু-ঋণ অর্থ দিয়ে পরিশোধ হয় না।